ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ, প্রতিকার ও করণীয়
প্রকাশিত: ৮ নভেম্বর ২০২২, ১২:২২ এএম

ছবিঃ সংগৃহীত
ডেঙ্গু জ্বর কি?
ডেঙ্গু জ্বর একটি ডেঙ্গু ভাইরাস জনিত রোগ। এই ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে এডিস মশা। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। রোগাক্রান্ত ব্যক্তির মাঝে আক্রান্ত হওয়ার ৩-১৫ দিনের মধ্যে এই রোগের উপসর্গ দেখা যায়।
ডেঙ্গু কিভাবে ছড়ায়?
কয়েক প্রজাতির স্ত্রী এডিস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়ায়। সবগুলোর মধ্যে প্রধান হলো এডিস ইজিপ্টি মশকী। পৃথিবীতে এই ভাইরাসের ৫টি সেরোটাইপ রয়েছে। যে কোনো একটি সেরোটাইপ কোনো ব্যক্তিকে সংক্রমন করলে, সেই সেরোটাইপ এর বিরুদ্ধে আজীবনের জন্য ব্যক্তির মধ্যে প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জিত হয়।
পরবর্তীতে অন্য যে কোনো সেরোটাইপ ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হলে রোগীর মধ্যে ভয়াবহতা দেখা দিতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত কোনো রোগীকে জীবাণুবিহীন কোনো মশা কামড়ালে, সেই মশাও ডেঙ্গুর বাহকে পরিণত হয়। এভাবে রোগী থেকেও ডেঙ্গু জ্বর ছড়িয়ে পড়ে। তবে ডেঙ্গু জ্বর ছোঁয়াচে কোনো রোগ নয়।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ বা উপসর্গ:
ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে ৩-১৫ দিনের মধ্যেই এ ধরনের লক্ষণ দেখা দেয়। নিচে সেগুলো উল্লেখ করা হলো:
১) উচ্চ মাত্রার জ্বর থাকে। জ্বর ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত যেতে পারে।
২) প্রচন্ড পরিমাণে মাথা ব্যাথা।
৩) সবসময় বমি বমি ভাব এবং মাঝেমধ্যেই বমি হওয়া।
৪) পুরো শরীরে ব্যাথা হওয়া, বিশেষ করে হাড়, জয়েন্ট এ ব্যাথা।
৫) নাক বা মাড়ি থেকে হালকা পরিমাণে রক্তপাত হওয়া।
৬) ত্বকে সহজে ক্ষত হওয়া।
৭) শারীরিক ক্লান্তি অনুভব করা।
৮) শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফুসকুড়ি উঠা।
বিভিন্ন ধরনের ডেঙ্গুর ধরণ রয়েছে। এদের মধ্যে দুটি নিচে উল্লেখ করা হলো:
ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর – Dengue Hemorrhagic Fever:
ডেঙ্গুর সবচেয়ে জটিল অবস্থা। এই জ্বরে সাধারণত নিচের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। পাশাপাশি আরও জটিল সমস্যা দেখা দিতে পারে।
১) রোগীর শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তপাত শুরু হয়।
২) অনেক সময় বুকে, পেটে পানি জমা এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।
৩) রোগীর লিভার আক্রান্ত হয়ে জন্ডিস হতে পারে।
৪) কিডনিতে আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
ডেঙ্গু শক সিনড্রোম – Dengue Shock Syndrome:
ডেঙ্গু জ্বরের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ এটি। ডেঙ্গু শক সিনড্রোম সাধারণত হয় ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের সাথে সার্কুলেটরি ফেইলিউরে। এর লক্ষণ গুলো নিচে দেওয়া হলো:
১) হঠাৎ করে রক্তচাপ কমে যাওয়া।
২) নাড়ির স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ এবং দ্রুত হওয়া।
৩) শরীরের হাত পা এবং বিভিন্ন অংশ ঠান্ডা হয়ে যাওয়া।
৪) হঠাৎ করে রোগী বিভিন্ন সময় জ্ঞান হারিয়ে যাওয়া।
৫) এক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী সাধারণ ৫-১০ দিনের মধ্যে নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। তবে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বর হলে করনীয়:
১) পরিপূর্ণ বিশ্রাম গ্রহণ করতে হবে।
২) তরল খাবার খেতে হবে।
৩) ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী প্যারাসিটামল খেতে হবে।
৪) ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীর শিরায় স্যালাইন দিতে হবে।
৫) মারাত্মক অবস্থা দেখা দিলে রোগীকে রক্ত দিতে হবে।
৬) ডেঙ্গু জ্বরে এন্টিবায়োটিক ও ননস্টেরয়েডাল ঔষধ সেবন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের করনীয়:
১) টিকা গ্রহণ করতে হবে।
২) এডিস মশার বাসস্থান নষ্ট করতে হবে।
৩) শরীরের বেশিরভাগ অংশ ঢাকে এমন পোষাক পরিধান করতে হবে।
৪) ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করতে হবে।
৫) মশার বংশ বৃদ্ধি হ্রাস করতে হবে।
৬) নিজের বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
ডেঙ্গু প্রতিকার ও প্রতিরোধে ঘরোয়া পদ্ধতি:
ডেঙ্গু জ্বর হলে সবসময় হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন নেই। অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বাড়িতে বসে এই রোগীর চিকিৎসা নেওয়া যায়। এছাড়াও বিভিন্ন ঘরোয়া পদ্ধতি রয়েছে। যেমন-
নিমের তেল: মশার উপদ্রব থেকে বাঁচতে খুবই উপকারী নিমের তেল। বাড়িতে নিমের তেল স্প্রে করলে মশার হাত থেকে বাঁচা যায়। এ ছাড়াও গায়ে ব্যবহার করলেও আমরা মশার কামড় থেকে বেঁচে যেতে পারি।
দুধ: দুধ একটি সুষম খাবার। যে কোনো রোগীর জন্যেই উপকারী। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
পেঁপে: পেঁপে শরীরে প্লাটিলেট এর পরিমাণ বৃদ্ধিতে সক্ষম। ডেঙ্গু জ্বরের কারণে শরীরে প্লাটিলেট এর পরিমাণ কমে যায়। পেঁপে পাতার রস এই পরিমাণ বৃষ্টিতে সহায়তা করে। এটি মালয়েশিয়ার এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির গবেষনায় প্রমানিত। তাই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর জন্য পেঁপে এবং পেঁপে পাতার জুস উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ।
মিষ্টি কুমড়া: মিষ্টি কুমড়াও একই ভাবে রক্তের প্লাটিলেট বৃদ্ধিতে কার্যকর। তাই মিষ্টি কুমড়াও গ্রহণ করতে হবে।
দেশী মাছ: আমাদের দেশী মাছে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান রয়েছ। যেগুলো আমাদের শরীরের জন্য খুব প্রয়োজনীয়। তাই আমাদের দেশী মাছ প্রচুর পরিমাণে খেতে হবে।
শেষ কথা:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের মোট ১১০টির বেশি দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হয়।প্রতি বছর পাঁচ থেকে পঞ্চাশ কোটি মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। তার মধ্যে দশ হাজারের বেশি মানুষ মারা যান। ১৭৭৯ সালে ডেঙ্গুর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। আমাদের দেশেও ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যায় প্রতিবছর।
এ বছরে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তেতাল্লিশ হাজারের বেশি মানুষ। ঢাকাতে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১০৩ জন মানুষ।
এছাড়াও দেশের আরও বিভিন্ন জায়গায় অনেক মানুষ মারা গেছেন। আমাদের সকলের তাই ডেঙ্গু বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ডেঙ্গুর টিকা এবং প্রতিকার ও প্রতিরোধের বিষয়গুলো মেনে চলা উচিত।