বন্ধুর স্মৃতি অমলিন হতে দেন নি নুরু মিয়া
প্রকাশিত: ১০ মার্চ ২০২৩, ১২:৪৯ এএম

ছবিঃ একাত্তর পোস্ট
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নূরু মিয়ার বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ আজও রয়ে গেছে ভারতের ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর পিতার নামে।
ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ডা. মানিক সাহার পরিবারের সাথে বাংলাদেশ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নূরু মিয়া মালদারের পরিবারের বন্ধুত্বের স্মৃতি আজও বহন করছে একটি বিদ্যুৎ সংযোগ।
ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ডা. মানিক সাহার পিতা মাখন লাল সাহা বেশ কয়েকবছর আগে ভারতের নাগরিক পঞ্জিতে প্রয়াত হিসেবেই নথিভুক্ত। তবে বন্ধুত্বের স্মৃতিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিদ্যুৎ বিভাগের নথিতে আজও প্রাঞ্জল অর্থাৎ জীবিত মাখনলাল সাহা। তবে এর মধ্যে কোন কপটতা বা অসাধুতা নেই। নিঃস্বার্থ ও অকৃপণ বন্ধুত্ব যে জাত, পাত, ধর্ম, কাঁটাতারের সীমানা সবকিছুর ঊর্ধ্বে এখানে আছে সেই নিদর্শন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পূর্বে ভারতের ত্রিপুরার আগরতলা শহরের প্রাণ কেন্দ্র গেদু মিয়া মসজিদ সংলগ্নের বাসিন্দা ছিলেন নূর মিয়া মালদার। তর সাথে গভীর বন্ধুত্ব ছিল অধুনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার টি রোডের কাজিপাড়ার প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ী মাখন লাল সাহার।
দেশ বিভাগের ইস্যুতে অশান্ত হয়ে উঠে বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত। দীর্ঘকাল ধরে লালিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আবহে অনাকাঙ্ক্ষিত বিষ ছড়িয়ে যায়।
এই হিংসার শিকার হতে হয় মাখন লাল সাহার পরিবারকেও। মাখনলাল সাহার বাড়ি ও ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানে লুঠ-পাট হয়। পরিবার নিয়ে বিপদে পরেন মাখনলাল সাহা। এমন দুঃসময়ে বন্ধুর পাশে এসে দাঁড়ায় আগরতলার নূর মিয়া মালদার।
নূর মিয়া মালদার আগরতলায় নিজ ঘর-বাড়ি ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান সহ যাবতীয় সম্পদ বন্ধু মাখনলালকে দিয়ে চলে আসেন বাংলাদেশে।
সে সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বাড়িতে মাখন লাল সাহার নামে যে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিলো বন্ধুত্বের স্মৃতি বিজড়িত সেই বিদ্যুৎ সংযোগ আজও রয়ে গেছে।
জানা যায়, নূর মিয়ার জীবদ্দশাতেই তার সন্তানদের বলে যায় এই বিদ্যুৎ সংযোগের নাম যাতে পরিবর্তন করা না হয়। পিতার নির্দেশ মেনে আজও সেই নাম অপরিবর্তিত রেখেছেন নূর মিয়ার পরিবার। এখনো প্রতিমাসে এই বাড়ির বিদ্যুৎ বিল আসে মাখন লাল সাহার নামে। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ডা. মানিক সাহার পরিবারও। নূর মিয়ার পরিবারের সাথে পরিচয় যোগাযোগ ছিল এবং এখনও আছে মাখনলাল সাহার পরিবারের। তবে প্রয়াত মাখন লাল সাহার বড় পুত্র তথা ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর বড় ভাই আগরতলার প্রসিদ্ধ ব্যাবসায়ী মোহনলাল সাহা থাকতে যোগাযোগ বেশি ছিলো। এরপর উভয় পরিবারের সদস্যদের পেশাগত ভিন্নতা ও ব্যাস্ততার জন্য যোগাযোগ কম হলেও বিস্মৃত নন কেউ।
তাই নয় মাস আগেই মাখন লাল সাহার ছেলে ডা. মানিক সাহা প্রথমবার যখন ত্রিপুরার অন্তর্বর্তীকালিন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন তখনও নিজেদের খুশি প্রকাশ করেছিলেন নূর মিয়ার পরিবারের সদস্যরা।
গত বুধবার ৮ ই মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে ডা. মানিক সাহা যখন দ্বিতীয়বার ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন তখনও বেশ আনন্দ উল্লাস করেন প্রয়াত নূর মিয়া মালদারের পুত্র কন্যা সহ অন্যান্য সদস্যরা।
নুর মিয়া মালদারের বড় কন্যা বলেন, ডা. মানিক সাহা আমার ভাই। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ায় আমরা অত্যন্ত আনন্দিত।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ বিভাগের ব্রাহ্মণ বাড়িয়া শহর ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী এস.কে.মজুমদার বলেন, বিষয়টি সত্য। নূর মিয়ার জীবদ্দশায় বা পরবর্তীতে তাদের পরিবার থেকে কখনো ভোক্তার নাম পরিবর্তনের আবেদন করা হয়নি। তবে তারা আবেদন করলে আমরা নাম পরিবর্তন করে দিবো।
তবে নুর মিয়ার পুত্র কন্যারা ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর পিতা বলে নয়, তারা তাঁদের পিতার বন্ধুত্বের স্মৃতি বিজড়িত দলিল হিসেবে এই নাম পরিবর্তন করবেন না বলে জানিয়েছেন।
এদিকে এই তথ্যটি সামনে আসার পর ত্রিপুরার বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের একটি অংশ আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেন। কারণ, ত্রিপুরায় বসবাসকারি বাঙ্গালিদের প্রায় ৯০% ই কোন না কোন সময়ে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ, তৎপরবর্তী সময়, সত্তুরের দশকের মুক্তিযুদ্ধের আগে পরে কিংবা পরবর্তী সময়ে ত্রিপুরায় এসেছেন তারা। এখনও ত্রিপুরার বহু মানুষের পরিবারের একাংশ, অসংখ্য আত্মীয় স্বজন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করেন। কাঁটাতারের বেড়া দেহ আটকে দিলেও মন ও অনুভূতিকে আটকাতে পারেনি। তাই স্মৃতিতে আজো প্রাঞ্জল হয়ে আছে আরো বহু মাখনলাল- নূর মিয়া মালদার।
ত্রিপুরার সদ্য প্রাক্তণ মূখ্যমন্ত্রী তথা এই সময়ে দিল্লির সংসদে ত্রিপুরা থেকে নির্বাচিত রাজ্যসভার সাংসদ বিপ্লব কুমার দেবের পৈতৃক ভিটে ও বাংলাদেশে। সেই ভিটে মাটিতে ত্রিপুরার সদ্য প্রাক্তণ মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি সাংসদের পরিবারের একাংশ আজও সেখানেই বাস করছেন। তার মাতুলের পরিবারও বাংলাদেশে।
২০১৮ সালের ১০ই মার্চ বিপ্লব কুমার দেব ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলে তাঁর বাংলাদেশের পৈত্রিক গ্রামের মানুষ ও আনন্দ উল্লাস করেছেন।