মুসলিম স্থাপত্যের নিদর্শন শাহজাদপুরের মখদুমিয়া জামে মসজিদ

সেলিম রেজা, সিরাজগঞ্জ

প্রকাশিত: ২১ এপ্রিল ২০২৩, ০৩:০৬ পিএম


মুসলিম স্থাপত্যের নিদর্শন শাহজাদপুরের মখদুমিয়া জামে মসজিদ

ছবিঃ সংগৃহীত

একাত্তর পোস্ট অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

দেশের বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে আছে মুসলিম ঐতিহ্যের অনেক নিদর্শন। এর মধ্যে কোনো কোনটি কয়েক'শ বছরের পুরাতন। এমনই একটি নিদর্শন হলো সিরাজগঞ্জের শেষ প্রান্তের উপজেলা শাহজাদপুরে করতোয়া নদীর দক্ষিণ-পূর্বদিকে অবস্থিত মখদুমিয়া শাহদ্দৌলা (রহ.) জামে মসজিদ।

বাংলার সুলতানী আমলে হযরত মখদুম শাহদৌলা শহীদ ইয়ামেনী (রহ.) এর নির্দেশে মসজিদটি নির্মিত হয়। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৫১ ফুট ৯ ইঞ্চি, প্রস্থ ৩১ ফুট ৫ ইঞ্চি এবং উচ্চতা ১৬ ফুট ২ ইঞ্চি। মসজিদের বাইরের দৈর্ঘ্য ৬২ ফুট ৯ ইঞ্চি, প্রস্থ ৪১ ফুট ৯.৫ ইঞ্চি এবং উচ্চতা ১৯ ফুট ১০ ইঞ্চি। দেওয়াল ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি পুরু। মোট ৫টি দরজা রয়েছে এই মসজিদের। প্রতিটি দরজার উচ্চতা ৭ ফুট ৫ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ৬ ফুট সাড়ে ৩ ইঞ্চি। মোট গম্বুজের সংখ্যা ১৫টি।

মসজিদটির মেঝে থেকে গম্বুজের শীর্ষ পর্যন্ত উচ্চতা ২০ ফুট ৯ ইঞ্চি। ছোট ইট, চুন ও শুরকি দিয়ে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদটিকে ধারণ করে রেখেছে কালো পাথরের মোট ২৪টি স্তম্ভ। বর্তমানে এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদের নাম ‘মখদুমিয়া জামে মসজিদ।’ মসজিদের বাইরে এবং ভেতরে প্রধানত ফলমূল ও লতাপাতার কারুকার্য রয়েছে। এই মসজিদ ঘিরে ইসলামের প্রচারণা চলে সিরাজগঞ্জ ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, আরব দেশের ইয়ামেন প্রদেশের শাসনকর্তা মোয়াজ-ইবনে জাবালের বংশধর শাহজাদা হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) ১১৯২ থেকে ১১৯৬ সালের মধ্যে কোনো এক সময়ে পানি পথে শাহজাদপুরে আগমন করেন। সেই সময় বর্ষায় থইথই পানিতে গোটা শাহজাদপুর দেখা যেত সাগরের মতো।

ইসলাম প্রচারে তার সঙ্গে ছিলেন, তিন ভাগ্নে কালীন দানিশমন্দ (রহ.), খাজা নূর (রহ.), খাজা আনওয়ার (রহ.)। তাঁরা সবাই ৭টি মতান্তরে ৪০টি জাহাজ/নৌকা যোগে নদীপথে রওনা হয়ে বোখারায় পৌঁছে সেখানকার সাধক সুফী জালাল উদ্দিন বোখারীর (রহ.) সঙ্গে দেখা করেন। কিছু সময় অতিবাহিত করার পর বাংলার এই অঞ্চলে আগমন করেন তারা।

আগমনের আগ মুহূর্তে হযরত জালাল উদ্দিন বোখারী (রহ.) একজোড়া ধূসর বর্ণের কবুতর মখদুম শাহদ্দৌলাকে (রহ.) উপহার দেন। যা জালালী কবুতর নামে পরিচিত।

সুদীর্ঘ নদীপথ অতিক্রমের পর অভিযাত্রী দলটির জাহাজ এক স্থানে এসে পৌঁছায়। যার বর্তমান নাম পোতাজিয়া (পোত অর্থ নৌকা আওজিয়া অর্থ ভিড়ানো) তাই ওই স্থানটির নাম পরবর্তীতে পোতাজিয়া রাখা হয়। হযরত মখদুম শাহদৌলার (রহ.) মসজিদের দুই মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে এ স্থানটি অবস্থিত। স্থানটি তখন ছিলো পানির নিচে, কোনদিকেই স্থল ভাগের চিহ্ন ছিল না।

বোখারীর কবুতরগুলো সকালে জাহাজ ত্যাগ করে সন্ধ্যায় ফিরে আসতো। কয়েকদিন পরে জাহাজের লোকজন কবুতরের পায়ে পলিমাটি ও বালির সন্ধান পেয়ে অদূরে কোথাও চর জেগেছে ধারণায় একটি ডিঙ্গি নৌকায় করে কয়েকজন কবুতরকে অনুসরণ করে একটি চরে পৌছায়। পানি ক্রমশ সরে যেতে থাকায় চরটি প্রশস্থ হতে থাকে এবং চর এলাকাটিই পরবর্তীতে হযরত মখদুম শাহদৌলার (রহ.) নাম অনুসারে শাহজাদপুর নাম করা হয়।

হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) এ অঞ্চলে আগমণ করে ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করলে তৎকালীন সুরে বিহারের অমুসলিম অধিপতি রাজা বিক্রম কেশরী তাঁর আগমনে ঈর্ষান্বিত হয়ে বাধা প্রদান করেন। সর্বমোট ৩৩ বার মখদুম শাহদ্দৌলার (রহ.) সঙ্গে যুদ্ধ হয় তার। প্রথম দুটি যুদ্ধে বিক্রম কিশোরী পরাজিত হন। শেষ যুদ্ধে পরাজিত বন্দীদের একজন গুপ্ত ঘাতক ইসলাম ধর্ম গ্রহণের নামে হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.) এর অত্যন্ত নিকট স্থান লাভ করে। 

একদিন হযরত মখদুম শাহদৌলাকে (রহ.) নামাজ পড়া অবস্থায় হত্যা করে পালিয়ে যায় ওই নব মুসলিম। হযরত মখদুম শাহদৌলার (রহ.) কাটা মস্তক যে স্থানে সমাহিত করা হয় তা ‘ছের মোকাম’ বলে পরিচিত। অন্যদিকে হযরত মখদুম শাহদৌলার (রহ.) দেহ মোবারক শাহজাদপুর মসজিদের দশ রশি দক্ষিণে দাফন করা হয়।

১৫০০-১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার মুসলিম সুলতানি আমলে এই মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তৎকালীন মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম কারুকার্য ব্যবহার করা হয় মসজিদ নির্মাণ কাজে। ১৫ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের উত্তর-দক্ষিণ দৈর্ঘ্য ১৩.১৯ মিটার, পূর্ব-পশ্চিম প্রস্থ ১২.৬০ মিটার এবং ছাদের উপরিভাগের গম্বুজের ব্যাস ৩.০৮ মিটার।

গম্বুজের প্রতিটি মাথায় পিতলের কারুকার্য মন্ডিত' যা দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। এটিই এই অঞ্চলের মুসলমানদের প্রথম বা বড় মসজিদ হিসেবে পরিচিত। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত মুসলিম এখানে নামাজ আদায় করতে আসেন।

এখন পর্যন্ত সর্বমোট দুইবার এই মসজিদটি সংস্কার করা হয়েছে। মসজিদের পাশে মখদুম শাহদ্দৌলা (রহ.)-এর কবরের ওপরে বিশাল আকৃতির গম্বুজ নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় সংরক্ষণ ও দেখাশোনা করা হয়।

মখদুমিয়া জামে মসজিদের দক্ষিণে প্রতি বছরের চৈত্র মাসে দু’দিন ব্যাপী ওরশ অনুষ্ঠিত হয়। ওরশে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লাখো ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণের সমাগম ঘটে।

মখদুমিয়া জামে মসজিদ ও মাজারে যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে বাসে করে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলা সদরের বিসিক বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে যাবেন। সেখান থেকে রিকশা অথবা সিএনজি চালিত অটোরিকশায় করে যাওয়া যাবে মাখদুমিয়া জামে মসজিদে।

মসজিদের খাদেম মাওলানা মো. হাফেজ বলেন, ইসলাম ধর্ম প্রচারের সময় মখদুমিয়া জামে মসজিদটি তৈরি হয়েছে। আমি এই মসজিদে খেদমত ও নামাজ পড়ার সুযোগ পেয়ে নিজেকে গর্বিত মনে করি। এই মসজিদে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষেরা নামাজ পড়তে এবং মানত করতে আসেন। মসজিদটির সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের বিশেষ নজর দেয়ার জন্য অনুরোধ জানান তিনি।

মসজিদের ইমাম মো. আকবর আলী জানান, ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ওলী, আউলিয়া ও দরবেশসহ অনেকেই এখানে আগমণ করেছেন। তাদের তৈরি করা আল্লাহ ঘর এই মখদুমিয়া জামে মসজিদে আমি দীর্ঘদিন ধরে ইমামতি করছি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে মুসল্লি অনেক বেশি হয়। তবে শুক্রবার মুসল্লিদের সংখ্যা বেড়ে যায়। অনেক সময় নামাজের জায়গা দিতে পারি না।

শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া আফরিন বলেন, মখদুমিয়া জামে মসজিদটি প্রাচীন নিদর্শন। জেলার যেসব দর্শনীয় স্থান রয়েছে তার মধ্যে এটি অন্যতম। মসজিদের নিরাপত্তা ও পবিত্রতা রক্ষায় সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।

সম্পর্কিত

আরও পড়ুন

Link copied